দেশ ও মানুষের কথা বলে

[vc_row][vc_column]

[/vc_column][/vc_row]

“নির্ধারিত প্রলয়”

জুন,১২,২০২২

“সুলেখা আক্তার শান্তা”

সহজ সরল মানুষ জামিল। তেমন প্যাঁচ গোজ বোঝেনা। বিধাতার আশীর্বাদে বংশের মধ্যে সবার চেয়ে ধনী। টাকা পয়সা
জমি জমা বেশি। জামিল বিয়ে করেও পেয়েছে সুন্দরী ও শিক্ষিতা বউ। হিংসা করে সবাই জামিলকে। জামিলের জমি জমা
বংশের অন্যান্য শরিকরা একজোট হয়ে দখলের চেষ্টা করে। জামিল চুপ থাকলেও চুপ থাকে না জামিলের বউ রুনা।
যখনই কেউ দখলের পাঁয়তারা করে রুনা তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। জমির কাগজপত্র নিয়ে স্বামীর প্রাপ্য অংশ বুঝে নেয়
সে। এতে অনেকের ভালো লাগেনা। রুনাকে বিয়ে করার আগে যে যেভাবে পারে জামিলের সম্পত্তি ভোগদখল করতো
কিন্তু রুনা আসার পর তারা তা করতে পারে না। এদিকে রূপসী রুনার সৌন্দর্যে দেওয়ানা জামিলের কুচক্রী চাচতো ভাই
বশির। সে দেখে জামিলের যেসব সম্পত্তি তার ভোগ দখলে ছিল রুনার তদারকির কারণে সেসব ছুটে যাচ্ছে। সে উপায়
খুঁজতে থাকে। রুনাকে বলে, তুমি এই বলদের সংসার করবা? ওর চেয়ে আমি শত শুন ভাল। তুমি ওকে ছেড়ে আমাকে
বিয়ে করো। রুনা বলে, যে কথা মুখ দিয়ে বের করছেন সে কথা ভুলেও জবানে আনবেননা। বশির বলে, শোনো শাড়ির
যেমন তোমাকে পেঁচিয়ে রাখে তেমনি আমি তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে পেঁচিয়ে রাখবো। আর শোনো তোমাকে যদি আমি
না পাই, জামিলের সংসারও তোমাকে করতে দেব না। সংসার করতে দেওয়ার আপনি কে? আর আপনি যা বলবেন তাই
আমি শুনবো ভাবলেন কি করে? শোনবা, শোনবা, না শুনলে সংসারও আমি করতে দেবো না তোমাকে। রুনা এসব
কথায় অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীকে বলে, তোমার ভাইরা যে কথা বলেন তা কি তুমি শুনতে পাও?
শুনতে পাই কিন্তু কি করব? ওরা খারাপ মানুষ ওদের সঙ্গে কথা না বলাই ভালো। আর জমির দখল করতেছে করুক
আমার এত জমি ক্ষেত দরকার নাই। আমার ঝগড়া ঝাটি করতে ভালো লাগেনা।
তোমার বউ নিয়ে যে টান দিতেছে তার কি করবা?
জমি ক্ষেত যা ইচ্ছা তাই হোক বউ আমার থাকবে।
আহ বলদা স্বামীর কথা কি! জমি ক্ষেত ঘরে নিয়ে দিয়ে আসো। জামিল সোজা সরল মানুষ হলোও বউয়ের প্রতি তার বেশ
ভালোবাসা। বউকে নিয়ে বিকাল হলে সুন্দর শাড়ি পরিয়ে বাগানে গিয়ে বসে। গল্প করে। রুনা আনন্দের সংবাদটি
জানায়। তার গর্ভে সন্তান এসেছে। শ্বাশুড়ি খুব খুশি হয়। কিন্তু বশির প্রতিহিংসায় জ্বলতে থাকে। শুরু করে চক্রান্ত। বশির
গ্রামে রুনার নামে মিথ্যা বদনাম রটায়। সে বলে বেড়ায়, রুনার গর্ভের সন্তান তার ঔরসজাত। নানা জনে নানান কথা
বলে। নারীর অপবাদের কথা পুরুষের অপবাদের চেয়ে দ্রুত বিশ্বাসযোগ্য হয়। রুনা অবাক, মানুষ কি করে এতটা
অমানুষ হতে পারে! স্বামীর নীরবতায় তার গা জ্বলে। বউয়ের নামে এমন মিথ্যা রটনা রটাচ্ছে তাতে স্বামীর নাই
প্রতিউত্তর। এদিকে পুরা গ্রাম ছড়িয়ে গেছে রুনার গর্ভে বশিরের সন্তানের কথা। রুনা এই মিথ্যা অপবাদের ভার সইতে না
পারে গর্ভের সন্তান নিয়ে আত্মহত্যা করতে যায়। ভোর রাতে যখন ফ্যানের সঙ্গে রশি বাঁধার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, শাশুড়ি
ফয়জরী দেখে ফেলে। চিৎকার শুরু করে, কে কোথায় আছো তোমরা আমার বৌমাকে বাঁচাও। বৌমা তুমি একবার
আমার কথা শোনো। কেউ তোমাকে বিশ্বাস না করলে আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। আমি তোমার সম্বন্ধে জানি তুমি
কেমন নারী। আমার দোহাই তোমার পেটের সন্তানের দোহাই তুমি এ কাজ করো না! জামিল দৌড়ে এসে স্ত্রীকে ঠেকায়।
ফয়জরী বলতে থাকে, মানুষের গঞ্জনায় আমার বউমা এই কাজ করতেছিল। আবোলতাবোল কথা বলে মানুষ কি সুখ পায়
বুঝিনা! এমন কঠিন কথা, সত্য মিথ্যা যাচাই করে বলা উচিত। আমার বৌমাকে নিয়ে কটু কথা বললে আমিও ছাইড়া
দিবোনা এর জন্য দরকার হলে আদালত করব। এই কথা শুনে মানুষের মিথ্যা রটনা স্তিমিত হয়। কেউ আর বদনামের
কথা প্রকাশ্যে বলে না।
রুনার মেয়ে সন্তান হয়। শাশুড়ি ফয়জরী খুব খুশি নাতনি পেয়ে। এদিকে বশির থেমে থাকে না। বলে, আমার সন্তান
জামিলের ঘরে মানুষ হবে আমার কোন খরচ পাতি লাগবে না! যাক মেয়ের বাবা হিসেবে আমি খরচ থেকে বেঁচে গেলাম।
আমার সন্তানকে জামিলও হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। রুনা শাশুড়িকে বলে, মা আমার নামে হাজার বদনাম দিলেও আমার

কিছু যায় আসে না। আমার সন্তানের গায়ে আমি কলঙ্কের দাগ লাগতে দিব না! রুনা মনে মনে ভাবে এখানে থাকলে আমার
সন্তানকে নিয়ে এমন কথার চালাচালি হবে। এখানে থাকবো না, আর কেউ এই কথা বলবেও না। স্বামীর নিস্পৃহতা আর
বোকামির কারণে যত দুর্ভোগে তার জীবনে। যে যা বলার সুযোগ পায়। বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে সে। রুনা কাউকে কিছু না
বলে সন্তান রেখে একদিন নিরুদ্দেশ হয়! রুনাকে খোঁজাখুঁজি করে কেউ তার সন্ধান পায় না। সে বাবার বাড়ি ওঠে না। সে
চলে যায় এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। সেখানে সে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নেয়। পরে রুনা স্বামীকে
ডিভোর্স দিয়ে একজনকে বিয়ে করে। সেখানে সংসার করতে থাকে।
জীবনে যার যন্ত্রণা লেখা থাকে তার ভাগ্যে সুখ আসে কোথাও থেকে। জন্মের পরে যখন শ্যামলী বুঝে তখন থেকে এই
যন্ত্রণা। তার জন্ম নিয়ে খোটাটা শুনে আসছে এ পর্যন্ত। মানুষের মুখ তো বন্ধ করা যায় না। মনে হয় তার জীবনটা যত
কাল থাকবে ততকাল একথা তাকে শুনতে হবে! যে যাই বলুক সবার কথাই কানে ভেসে আসে কিন্তু কারো কথা প্রতিউত্তর
করেনা সে। এখান থেকে দূরে কোথায়ও গেলে বাঁচা যেত। তাও হয় না। এক এক করে কম তো বিয়ের প্রস্তাব এলো না,
সব বিয়ের ঘরে ভেঙ্গে যায়। যে মেয়ের জন্মের ঠিক নেই সে মেয়েকে কেই বা বিয়ে করতে চাইবে! আর মানুষও যেন ওত
পেতে থাকে কে কখন আসবে। তাকে শ্যামলীর জন্মরহস্য বলতে হবে যাতে বিয়েটা ভেঙে যায়। বিয়ে করার ইচ্ছা তার
মিটে গেছে। বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে একি গঞ্জনা শুনতে হবে। মা তো জীবন যন্ত্রণায় টিকতে না পেরে নতুন জীবনের
সন্ধানে এখান থেকে পালিয়ে ছিল। বাবা চিরকাল সহজ সরল। মুখে কোন কথা নাই। যে যা বলে তাই সে কান পেতে শুনে
যায়। শ্যামলীর জীবনে আজন্ম জ্বালা। মা চলে যাবার পর বাবা বিয়ে-শাদীও করেনি। বিয়ে করে কেউ সংসারের হাল
ধরবে এমন চিন্তাও তার নাই। শ্যামলী ভাবে, আমার কথা চিন্তা করে হয়তো বাবা আর বিয়ে করেনি। আমার সুখের কথা
ভাবে! আমি কি সুখে আছি! শ্যামলী ক্ষুব্ধ অভিমানে বলে, আমিও সুখ চাই না, দুঃখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে চাই।
ফয়জরী নাতনি কে বলেন, মানুষের খেয়ে দেয়ে যেন কাজ নাই। কার কি সর্বনাশ করা যায় তাই নিয়ে মানুষ সারাক্ষণ
ব্যস্ত থাকে। আর আমাদের ভাল পাত্র দরকার নাই। অর্থ-সম্পদ কম আছে এমন পাত্র দেইখা বিয়া দিব। খোটা দিব না।
টাকা পয়সা আলা দেইখা বিয়া দিলে শক্তিমানরা শক্তি দেখাইবো। ছেলেটাও আমার লোক সমাজে মাথা খাটো করে রাখে।
ওর এমন মেনি বিড়াল স্বভাবের কারণে সংসারের আজ এই দশা।
জামিল মাকে বলে, শকুনের কাজ শকুন করবে। তাদের কি কোন কিছু দিয়ে থামানো যাবে? রুনা দীর্ঘদিন পর মেয়ে
শ্যামলীর খোঁজে আসে। সে জানে তার মেয়ের বিয়ে হয়নি। সে মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়। রুমা মনের সঞ্চিত ক্ষোভ
অভিমানে জানায় নিজের কথা। মা আমি চলে গেলাম যাতে আমার মেয়ের গায়ে কোন দাগ না লাগে কিন্তু দেখি সে দাগ
লেগেই আছে। একটা মেয়ের জীবনে দুইটা বিয়ে কেমন অসহনীয় যন্ত্রণাময় যার জীবনে ঘটেছে সেই জানে। আমি
কয়েকবার মরতে গিয়েও মরতে পারি নাই। আপনার ছেলেও আমার জীবন যন্ত্রণার অভিশাপ থেকে রেহাই পাবে না!
ফয়জরী রুনার দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে বলেন, জামিল কি রকম তা তো জানোই?
নিজের ছেলে সাফাই গাইবেন না। আপনার ছেলের নির্বোধ ভালো মানুষির কারণে আজ আপনি সুখে আছেন বলেন? সুখ
সে নিজেও পায় নাই কাউকে সুখী করতেও পারে নাই। আমি ঘটকের মাধ্যমে একটা পাত্রীর সন্ধান পাইছি। আমার ওইখানে
নিয়ে তো শ্যামলীকে রাখতে পারব না। আমাদের বিয়ের সময় স্বামী বলে দিয়েছিল আমার সন্তানকে আমার কাছে রাখতে
পারব না।
ফয়জরি বলেন, বৌমা ভয় তো একজনকেই পাই সে হচ্ছে বশির। তোমার জীবনটা তছনছ করেছে এখন ধরেছে তোমার
মেয়ের জীবন। খারাপ মানুষের সহজে মৃত্যু হয় না!
শ্যামলী মাকে বলে, মা আমার জীবন নিয়ে ভেবো না। আমার যা হবার তাই হবে। আর কোন ঝামেলা জড়াতে চাইনা।
ওই একই কথা বারবার শুনতে আর ভালো লাগেনা। মানুষ না জেনে না শুনে অনেক কথাই বলে। তোর বাবার সম্পত্তি
আমি রক্ষা না করি তাহলে আমার এই কলঙ্ক মাথায় নিতে হতো না। একজন মাই জানে তার সন্তানের পিতা কে। সংসারে
এমন আজগুবি অপবাদে বহু জীবন নষ্ট হলেও তার কোন প্রতিকার নেই।
পাত্র রোহান শ্যামলীকে দেখে পছন্দ করে। ছেলের পছন্দে রোহানের বাবা তোফায়েল আহমেদ বিয়ের পাকাপোক্ত কথা
বলেন। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। বড় অনুষ্ঠান করে মেয়ের বিয়ে দেবে জামিল। বশির সহজাত ঈর্ষাপরায়ণতায়

ভোগে। কারো সুখ তার সয়না। সে শ্যামলীর বিয়েতে ভাঙ্গানি দেয়। ছেলের বাবা তোফায়েল আহমেদকে সেই পুরনো
কিচ্ছা বলে বিভ্রান্ত করে। ছেলেকে যে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে করাছেন সেই মেয়ের বাবা আমি। আমার কাছে বিয়ের জন্য না
এসে অন্য একজনের কাছে গেছেন ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে! তোফায়েল আহমেদ কি বলবে বুঝে উঠতে পারে না। দ্বিধা
দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। গ্রামের সকলের কাছে জিজ্ঞেস করেন মেয়ে কার তাহলেই আপনি
জানতে পারবেন। আমি আর কিছু বলতে চাই না। বশির এমনই একজন ব্যক্তি সে যত অপকর্ম করুক কেউ তার বিরুদ্ধে
কোন কথা বলতে চায় না। বললে তার পরমায়ু সংক্ষিপ্ত হয়ে যাবে সেই ভয়ে। বশির শুধু লক্ষ্য কার ঘরে সুন্দর বউ আছে
কার সুন্দর মেয়ে আছে। তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হলেও বিনা প্রতিবাদে সবাইকে তা সহ্য করতে হয়। তোফায়েল আহমেদ
এমন কথা শুনে ছেলের বিয়ে ভেঙ্গে দেন। সে জানিয়ে দেন জামিলকে। শ্যামলী দাদীকে বলে, বিয়ে হয়নি তাও ভাল। বিয়ে
হয়ে ঘর ভেঙ্গে যাওয়ার চেয়ে বিয়ে না হওয়াই ভালো হয়েছে!
বশির একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে উঠতে পারে না। দেখে তার দুই হাত দুই পা অবশ হয়ে বিছানায় লেগে
আছে। ডাক্তার বলেছে প্যারালাইস। টিটমেন্ট করেও ভালো হয়না। বিছানায় শুয়ে চিৎকার করে বলে, তোমরা আমাকে
মাফ করে দাও আমি তোমাদের সঙ্গে অনেক অন্যায় করেছি তার প্রতিফল আমি এখন পাচ্ছি। সে খবর দেয় তোফায়েল
আহমেদকে। খবর পেয়ে তোফায়েল আহমেদ আসেন। বশির বলে, আমি ভুল করেছি আমাকে মাফ করে দেন। আমি জানি
আমার ভুলের কোন ক্ষমা নেই। আমি মিথ্যা কথা বলে শ্যামলীর বিয়ের ঘর ভেঙ্গে দিয়েছি। শ্যামলীর মাকে আমার ভাল
লেগে ছিল। আমি বিয়ের প্রস্তাব দেই সে রাজি না হওয়ায় আমি তার নামে কলঙ্ক দেই। আমি এরকম একটা না অনেক
সংসার তছনছ করে দিয়েছে। অনুরোধ যদি পারেন আমার কাছে রুনাকে নিয়ে আসেন। আমি ওর কাছে মৃত্যুর আগে ক্ষমা
চেয়ে নেব। তোফায়েল আহমেদ রুনাকে আনেন। বশির রুনাকে পেয়ে কেঁদে বলে, আমাকে ক্ষমা করো, আমি যৌবনের
লালসায় যে ক্ষতি করেছি তোমার তা ক্ষমার অযোগ্য। আমার এমন ক্ষতিতে অনেক মানুষের জীবন জ্বলে পুড়ে ছারখার
হয়েছে। রুনা বলে, মানুষ বুঝতে পারে কিন্তু সময়ের সীমানা অতিক্রম করে বুঝতে পারে। তখন কিছুই করার থাকেনা।
যাক জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আপনি আপনার ভুল বুঝতে পারছেন। তাতে খুশি হলাম। আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম।
শ্যামলীর বিয়ে হয় রোহানের সঙ্গে। শ্যামলী সুখে শান্তিতে সংসার করে। রুনাও শান্তি পায় তার কলঙ্ক আর অপবাদের
অবসান হয়েছে। রুনা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ ভুলে সুখী হতে চেষ্টা করে।

www.bbcsangbad24.com

Leave A Reply

Your email address will not be published.