নভেম্বর,১৯,২০২২
“সুলেখা আক্তার শান্তা”
রেমা আবার গৃহবন্দি। রেমা এখন আর রুমের মধ্য থেকে বের হতে পারে না। বন্দিদশায় ভাবে, না পারছি রবিনকে চাপ
দিতে না পারছি বাবা—মাকে বুঝাতে। এভাবে দুদিন পার হলো। বিয়ের দিন শুক্রবার ঘনিয়ে এলো।
আজ রেমার গায়ে হলুদ। গায়ে হলুদ দেয়ার জন্যে রেমাকে যখন শাড়ি পরাল তখন রেমার দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে। কোন
কথাই বলছে না। হঠাৎ ঢলে পড়ে গেল রেমা। চিৎকার হৈ চৈ পড়ে গেল। মা কাঁদতে লাগল কী হলো আমার মেয়ের। দ্রুত
ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তারের প্রাথমিক চিকিৎসার পর রেমা একটু একটু করে তাকাল।
মা তোর কী হয়েছে? বল আমাকে। কান্নাজড়ির কণ্ঠে মা অহনা বলল।
রেমা কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না। এদিকে রবিন রেমার সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছে না। রবিনের মনও
অস্থির। রেমার সাথে কী করে যোগাযোগ করা যায় তাই ভাবছে। রেমার বান্ধবীর কাছে খোঁজ নিলো। অনা, আমি রেমার
খোঁজ পাচ্ছি না।
কীভাবে পাবেন, ও তো নিজেই এখন ঠিক নেই। ও তো হসপিটালে।
বলো কি, এতকিছু হয়ে গেল আর আমি জানি না! তুমি আমাকে হাসপাতালের নাম বলো। রবিন ঠিকানা নিয়ে তাড়াতাড়ি
রেমার কাছে গেল। গিয়ে দেখতে পেল রেমা ঘুমাচ্ছে। রেমার বাবা মি. আনান ‘তুমি এখানে কেন? বেরিয়ে যাও’ বলে দূর
দূর করে তাড়িয়ে দিল রবিনকে। তারপর ডাক্তার এসে রেমাকে দেখল। আনান জানতে চায়, আমার মেয়েকে এখন কী
অবস্থায় দেখলেন ডাক্তার।
আপনার মেয়ে একটি কঠিন মানসিক আঘাত পেয়েছে, তাই সে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। আল্লাহকে ডাকুন।
আমার মেয়ের এ কী হলো! তুমি থাকো তোমার আভিজাত্য নিয়ে। একথা বলে অহনা কাঁদতে থাকে।
এসব তুমি কী বলছো, তুমি শান্ত হও রেমার মা।
আমাকে তো শান্ত হতেই হবে। শোন, সবাই সব আঘাত সইতে পারে না। আমার মেয়েও তাই পারেনি। ও তো ছোট থেকে
দুঃখ কষ্ট কী তা জানে না, তাই তো এ আঘাত ও সইতে পারেনি।
রবিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে নানা কথা ভাবছে। ভাবছে— চোখের সামনে আমার ভালোবাসার মানুষটি এরকম হয়ে যাচ্ছে।
না পারছি ওর কাছে থাকতে, না পারছি ওর জন্য কিছু করতে। যেমন করে হোক ওকে ভালো করে তুলতে হবে। রবিন
আবার আসে রেমার কাছে। দিশেহারা আনান সাহেব এবার বাধা দেন না। কাছে দাঁড়িয়ে রেমাকে অনেক কথাই বলে
রবিন। কোন কথারই উত্তর দেয় না রেমা। রেমা এখন কাউকে চেনে না। কোন কথাও বলে না। নির্বাক শুধু তাকিয়ে
থাকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রবিন বেরিয়ে যায়। দুপুরে আবার আসে। এবার বাধা দেয় মি. আনান— কি ব্যাপার তুমি
আবার এসেছো? এতকিছু বলার পরও।
আপনি যত কথাই বলুন রেমা যেখানে আছে আমি সেখানে আসব।
তোমার জন্য দেখছি আমার মেয়েকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে।
কোথায় সরাবেন? চোখের আড়াল হয়তো করতে পারবেন, কিন্তু মনের আড়াল করবেন কীভাবে? আর আপনি
আভিজাত্যের কথা চিন্তা করে বর্তমান সময়কে নষ্ট করছেন।
তোমার জন্য আজ আমার মেয়ের এ অবস্থা।
বুঝতেই যখন পারছেন তাহলে কেনই বা মেয়েকে এত কষ্ট দিচ্ছেন? আপনার মেয়ে থাকবে ভালো, পরবে ভালো, অথচ
আপনি আপনার মেয়ের সুখের কথা একবারও ভাবছেন না। হায়রে নিয়তি! বাবা কীভাবে এমন হয়?
আমি তোমার কোন কথাই শুনতে চাই না। আমার মেয়ে যেখানে থাকবে তার ধারে কাছেও তোমাকে দেখতে চাই না।
আপনার মেয়ের এমন অবস্থার পরও যখন আপনি বুঝতে চাইছেন না, তাতে আমিই বা আপনাকে বুঝাব কী করে? আপনি
বাবা, মেয়ের ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব আপনার। এমন ভালো দেখবেন না, যে ভালোতে আপনার মেয়ের জীবন পুড়ে নষ্ট
হয়ে যায়। সে যন্ত্রণায় আপনাদেরও পুড়ে ছারখার হতে হবে। আজ যদি আমার সব থাকতো তাহলে আমার ভালোবাসার
মানুষটিকে এভাবে কষ্ট পেতে হতো না। একথা বলে রবিন চোখ মুছতে মুছতে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়।
জ্ঞান ফিরলে রেমা ‘রবিন রবিন’ বলে ডাকতে থাকে।
মা তুই এমন করছিস কেন? আমি তো তোর পাশে আছি। তুই কথা বল, মা তুই কথা বল। রেমার মা অস্থির হয়ে যায়।
আনানকে প্রশ্ন করল, কেন আমার মেয়ে কথা বলছে না। আমাকে মা বলছে না, আমি মা ডাক শুনতে পারছি না। আমি
যে ওর মুখের মা ডাক শুনতে চাই!
আমার মেয়ে এখানে ভালো না হলে আমি বিদেশে চিকিৎসা করাবো, দেখবে আমাদের মেয়ে ভালো হয়ে যাবে।
তা তুমি পারবে, কারণ তোমার টাকা আছে। তোমার তো অনেক টাকা, যে টাকায় তুমি বড়লোক মেয়ের জামাই পাবে।
দাও না এখন মেয়ের বিয়ে?
তুমি এমনভাবে বলছো যে, মেয়ের ভালো চাওয়া অপরাধ।
তুমি তো মেয়ের ভালো চাও, এবার আমি না হয় আমার মেয়ের ভালো চাই, তুমি একটা কথাও বলবে না। একথা বলে
ডাক্তারের কাছে গেল মিসেস আনান। ডাক্তার সাহেব, ওর জন্যে কী করতে হবে বলুন। আমি আমার মেয়েকে আগের মতো
দেখতে চাই।
ডাক্তার বললেন, দেখেন, আমরা ডাক্তার। রোগীকে পারফেক্ট ট্রিটমেন্ট দিয়ে সুস্থ করা আমাদের কাজ। আর বাকিটা
আল্লাহর ইচ্ছা। রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি যাক সেটাই তো আমরা চাই। তবে আপনার মেয়ে মানসিক আঘাত পেয়েছে।
আপনার মেয়ে যে নামটি বার বার বলছে তাকে ওর সামনে হাজির করলে ভালো একটা কিছু আশা করা যায়।
ঠিক আছে ডাক্তার, আমি তাই করব। একথা বলে রেমার মা ডাক্তারের রুম থেকে বের হলো। স্বামী আনানকে বলল,
আমি যা করছি আমার মেয়ের ভালোর জন্য করব, তুমি এর মধ্যে কোন কথা বলবে না। আনান বিমর্ষ হয়ে বলল, মেয়ের
যদি ভালো হয় তাহলে কর, আমি তো মেয়ের ভালো চাই।
অহনা রবিনের খোঁজে গেল অনার কাছে। মা অনা, তুই আমাকে রবিনের খোঁজ দিতে পারবি?
হ্যাঁ খালাম্মা, পারব।
তাহলে চল মা আমাকে নিয়ে। তারপর দুজন গেল রবিনের কাছে। রবিনকে পেল।
অহনা বলল, বাবা রবিন, আমি তোমার কাছে এসেছি।
খালাম্মা আগে আপনি বসুন তারপর আমি আপনার কথা শুনছি।
বাবা আমি বসতে আসিনি।
কেন খালাম্মা আমি গরীব বলে?
গরীবের যে সম্পদ আছে একজন ধনীর কাছে সে সম্পদ নেই। গরীবের কাছে আছে অমূল্য সম্পদ যার নাম হচ্ছে
ভালোবাসা, যা ধনীর কাছে নেই।
খালাম্মা, রেমা এখন কেমন আছে?
বাবা, আমি সে জন্যেই তোমার কাছে এসেছি। রেমা এখনো অচেতন অবস্থায় ঘুমের ঘোরে বার বার ‘রবিন রবিন’
করছে।
আপনি সেজন্যে এসেছেন আমার কাছে? আপনারা পারেনও বটে।
তুমি যা খুশি বলতে পারো।
কিছু মানুষ আছি আমরা, শুধু দিতে পারি নিতে পারি না। আমি যাবো খালাম্মা। রেমা হচ্ছে আমার ভালোবাসার মানুষ,
ওর জন্যে আমাকে যেতেই হবে, চলুন।
রেমার পাশে বসলো রবিন। ‘রেমা রেমা’ বলে ডাকলো। রেমা একটু চোখ খোলে। মার দিকে তাকায়। অহনার মুখে একটু
হাসি ফুটল। রবিন বলল, রেমা আমি এসেছি, তুমি আমার সাথে কথা বলো, আমাদের আর কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
তুমি আমার সাথে কথা বলো। আনন্দে বিগলিত হয়ে বলে রেমা, রবিন তুমি এসেছো? আর দূরে যাবে না তো আমাকে
রেখে?
না আমি কখনো তোমায় রেখে দূরে যাবো না।
চলো আমরা এখান থেকে অনেক দূরে চলে যাই।
যাবো, আগে তুমি সুস্থ হও। তারপরে যাবো আমরা।
মারে, তোর কী হয়েছিল? কেন তুই আমার সাথে কথা বলছিস না। আমি যে তোর মুখে মা ডাক শোনার জন্য অস্থির হয়ে
আছি। তুই একবার মা বলে ডাক আমায়।
রেমা ডুঁকরে কেঁদে ওঠে। বলে, মা আমাকে তোমার বুকে নাও মা।
আয় মা তুই আমার বুকে আয়, আর কোন অশুভ শক্তি তোকে গ্রাস করতে পারবে না।
অনান কেবিনে ঢুকে রবিনকে দেখে কপাল কুঁচকায়। বিরক্ত হয়ে রেমার মাকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার এ ছেলে এখানে
কেন, একে এখানে ঢুকতে দিলো কে? অহনা এতকিছুর পরও তুমি একথা বলছো? মেয়ের দিকে একবারও তাকাবে না?
আনান বলে, আমি যা করছি তোমাদের ভালোর জন্যেই করছি।
আর আমাদের ভালো চাইতে হবে না। অনেক ভালো করেছ, এখন থামো, তুমি এখন বাসায় যাও, তোমাকে আবার অফিস
করতে হবে। তোমার তো অনেক অনেক টাকার প্রয়োজন, তুমি তো আমাদের সুখ দিতে চাও। অনেক সুখ, যে সুখে আজ
আমাদের স্বপ্ন বিলীন হতে বসেছে।
ঠিক আছে তুমি যা ভালো বুঝো তাই করো। কিন্তু মেয়ে আগে সুস্থ হোক, মেয়ের ভালোর জন্যে আমি মেনে নিলাম।
তোমরা থাকো, আমি এখন বাসায় চললাম। অহনা রবিনকে বলে, বাবা তুমি কিছু মনে করো না।
ঠিক আছে আমি কিছু মনে করবো না। তবে যন্ত্রণার ভার সবাই সইতে পারে না। আমার যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ভার
আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন, কপালে যা আছে তা তো হবেই।
রেমা রবিনকে পেয়ে মনে শক্তি ফিরে পেল। একটু একটু করে কথা বলতে লাগল। রেমা মাকে বলল, মা রবিনের হৃদয়ের
সাথে আমার হৃদয়ের জোড়া। যদি তোমরা তা ছিন্ন করো তাতে হারাতে পারবে তোমাদের সন্তানকে? এছাড়া আর কিছু
ফল হবে না মা।
তুই থাম মা, আগে সুস্থ হ। আমি এ বিষয়ে তোর বাবার সাথে কথা বলবো। মেয়ে তার একার নয়, মেয়ে আমারও। সিদ্ধান্ত
নেয়ার অধিকার আমারও আছে। আয় মা, আমি এখন তোকে খাইয়ে দিচ্ছি।
আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।
তোকে খেতে হবে যে মা।
আমি সুস্থ হলে তো বিয়ে দিয়ে দেবে তোমরা। আমি তো এ বিয়ে করতে চাই না মা। আমি খাবো না এ বিয়ে বন্ধ না হওয়া
পর্যন্ত।
তুই খেয়ে নে, আমি বন্ধ করব এ বিয়ে।
তুমি কি পারবে বাবার সিদ্ধান্ত থেকে তাকে সরাতে?
আমাকে যে পারতেই হবে, নইলে যে আমি আমার মেয়েকে হারাব।
রবিন বলে, রেমা তোমার এখন কথা না বলাই ভালো। যে বিষয়টা নিয়ে তুমি এখন ভাবছো, আগে সুস্থ হও তারপর না
হয় তা নিয়ে ভেবো?
আমি সুস্থ অসুস্থ কিছুই জানি না। এ বিয়ে বন্ধ করতে হবে, আজ আমি যে অসুস্থ তা এ বিয়েকে কেন্দ্র করে।
তুমি কি চাও আমি তোমাকে হারাই? তোমার এ অবস্থা দেখে আমার কি ভালো লাগছে? আমি কি তোমাকে ছাড়া থাকতে
পরবো? যা করব আমরা দুজনে মিলেমিশে করব। খালাম্মা তো আমাদের সাথে আছেন।
বাবা, তুমি ওকে বুঝাও। সন্তানের জন্যে মায়ের বুকের মধ্যে কেমন করে, তা শুধু মা—ই বোঝে।
ঠিক আছে মা, আমি তোমাদের কাছে কিছু চাইব না। আমি শুধু রবিনকে চাই। এছাড়া আমার কিছু চাওয়ার নেই।
আমাকে আর তোর কিছু বলতে হবে না।
www.bbcsangbad24.com